মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১০ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষক

ড. আতিউর রহমান:
আমরা বুঝতে পারছিলাম তাকে আর ধরে রাখা যাবে না। তবুও মন থেকে এই সত্যটি মেনে নিতে পারছিলাম না। সর্বক্ষণ তার ছোট ভাই খোন্দকার মুহম্মদ খালেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম। কভিড থেকে রেহাই পেলেন।

এক দু’দিন হাসপাতালে রেখেই বাসায় নেওয়ার কথা। তাকে সেবাযত্ন করবেন সে-রকম একজন প্রশিক্ষিত নার্সও ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা ভাবি এক, আর বাস্তবে ঘটে অন্য কিছু। শেষ পর্যন্ত আমাদের এক ভয়াল শূন্যতায় ফেলে রেখে একা একাই চলেই গেলেন না ফেরার দেশে। এই বাস্তবতা যে কী কষ্টের তা বোঝাই কী করে? তিনি ছিলেন আমার আত্মার আত্মীয়। আমার বড় ভাই। আমার দুঃখের ও সুখের সাথী।
কভিড আসার আগ পর্যন্ত এমন কোনো সপ্তাহ নেই যে তিনি অন্তত একবার আমাদের বাসায় আসেননি। আর টেলিফোনে তো যোগাযোগ ছিলই।

ব্যাংকিং খাতের বাইরেও তিনি আমাদের নানা উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমার প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন সমন্বয় ও সমুন্নয়’ দেখে রাখতেন। ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’-এর সভাপতির দায়িত্ব মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পালন করে গেছেন। তার পরিচালিত কচিকাঁচার মেলার সঙ্গে ছিল আমার প্রাণের সম্পর্ক। তিনি সত্য, সুন্দর এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সব সময়ই আপসহীন ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের কপালে যখন অন্ধকার নেমে এসেছিল তখনো তিনি পূবালী ব্যাংকে তার অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে রেখেছিলেন। দায়িত্ব শেষ করে সেই ছবি সযত্নে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। ‘দুষ্ট’ লোকদের কারণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের আমলেও আর্থিক খাতকে আরও বেশি দিন সেবা করতে পারেননি। যে ক’দিন দায়িত্বে ছিলেন আমার সঙ্গে কত বার যে গ্রামে গিয়েছেন প্রকাশ্যে কৃষিঋণ দেওয়ার জন্য সে হিসাব নাই বা দিলাম। তার মনের দুঃখ আমি জানতাম। সে সব কষ্টের কথা আজ নাই বা বললাম। কত স্মৃতি, কত কথা আজ মনে ভাসছে। পেশাদারি কাজে শেষ বার তার সঙ্গে বসেছিলাম বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার উপলক্ষে। এই দুর্ভাগা দেশে এমন ভালো এবং ন্যায়পরায়ণ মানুষ খুব বেশি জন্মায় না। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রপথিক হিসেবে দেশের মানুষের কাছে তিনি বরেণ্য। তার মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
১৯৬৩ সালে যোগ দেন ব্যাংকিং পেশায়। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। ব্যাংকিং ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে ২০০৯ সালে ‘খান বাহাদুর আহছানউল্লা স্বর্ণপদক’ ও ২০১৩ সালে ‘খান বাহাদুর নওয়াব আলী চৌধুরী’ জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০০০ সাল থেকে তিনি কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার পরিচালক, নির্বাহী পরিষদের সভাপতি ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

পেশাদারিত্বের দিক থেকে তিনি তার মান রক্ষা করতে চেষ্টা করতেন সব সময়। খুব কাছ থেকে দেখেছি, তিনি যখন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তখন নতুন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবী ও যোগ্যদের বাছাই করার ওপর বেশ জোর দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে ভাইভা বোর্ড গঠন করলেন। আমার মনে আছে, সেই নিয়োগে কোনো ধরনের তদবির ছাড়াই কর্মী নিয়োগ দিলেন এবং তাদের একটি প্রবেশনারি পিরিয়ড দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। উপযুক্ত জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুললেন। এর ফল আমরা দেখতে পেয়েছিলাম কিছুকাল পরে। যে পূবালী ব্যাংক এক সময় ৩০-৪০ শতাংশ খেলাপি ঋণ ছিল সেই হার তার ব্যাংক পরিচালনার ৫-৬ বছরে ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। ব্যাংকটির সুনাম প্রতিষ্ঠিত করলেন। ব্যাংকটিকে ভালো একটি অবস্থানে তুলে আনলেন।

একই সঙ্গে তিনি এমবিএ সমিতিরও সভাপতি ছিলেন। সেখানেও আমি গিয়েছি। সেখানকার সদস্যদের সমকালীন অর্থনীতি, সমাজ সম্পর্কে অবহিত করবার জন্য তিনি বিশেষ বিশেষ সম্মেলন ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করতেন। একই ধরনের কাজ তাকে করতে দেখি যখন তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের মোজাফফর আহমদ চেয়ার অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানেও তিনি ব্যাংকারদের রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, পরিদর্শন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কে ব্যবহারিক উদাহরণ দিয়ে পড়াতেন। সুতরাং জনশক্তি তৈরি করবার ক্ষেত্রে তার একটি বিরাট অবদান আছে আমাদের দেশে। কেবল যে সমাজকে সচেতন করতেন তা নয়, তিনি তরুণদেরও আদর্শ ও যোগ্য জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিতেন।

তার স্পষ্টবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসাএগুলো তো আমরা এতদিনে ভালোই জেনেছি। কিন্তু তার যে পেশাদারিত্ব সেটাও কিন্তু মনে রাখতে হবে। আর তিনি কতটা ন্যায়পরায়ণ ছিলেন তা তার জীবনের চলাফেরা দেখলেই বোঝা যায়। সেই অর্থে তার হাতে কিছুই ছিল না মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচ মেটানোও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। আমার সঙ্গে তার একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল। সেই অগ্রণী ব্যাংক থেকে তার সঙ্গে পরিচয়। লুৎফর রহমান সরকারের সঙ্গে তখন তিনি কাজ করতেন। ওই কাজের মধ্যে মানবিক দিকগুলো বেশি ফুটে উঠত বলেই আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর হয়। তিনি প্রথম ব্যাংক এমডি হিসেবে গ্রামে-গঞ্জে সফর করে সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতেন স্বচ্ছ ব্যাংকিং করার জন্য। তার কাছে কেবল আমাদের আর্থিক খাতই কৃতজ্ঞ নয়, গোটা তরুণ জনগোষ্ঠীই তার কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ। কারণ তিনি নৈতিকতার কথা বলতেন, মূল্যবোধের কথা বলতেন, দেশপ্রেমের কথা বলতেন। আর তিনি ছিলেন এদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি বড় শক্তি। তিনি কেবল ব্যাংকারই ছিলেন না, একজন সংস্কৃতিমনা একজন ব্যক্তিত্ব আর তরুণদের ভরসার জায়গা।

আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির ভুবনের উজ্জ্বল প্রদীপগুলো একে একে নিভে যাচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের এই শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তার আত্মা শান্তিতে ঘুমাক সেই প্রার্থনাই করছি। পরিবারের সদস্য এবং তার অসংখ্য গুণগ্রাহীর জন্য রইল গভীর সমবেদনা।

লেখক : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION